সাইমুম আনা’ম সাজিদ
শুভ্র সকালে ঘন কুয়াশাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছেন রিকশাচালক গফুর মিয়া। যদিও আজ হাড়কাঁপানো শীত। তবুও কি আর করার, পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব একমাত্র তার কাঁধেই ন্যস্ত। বয়স আর কত হবে! বড়জোর পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু এ বয়সে এসেই শরীরটা রোগা-পাতলা হয়ে গেছে।সেই সকালে দু-মুঠো পান্তা ভাত নুন মরিচ সমেত খেয়ে বেরিয়েছেন। একে তো শীতের সকাল, তারপর আবার দুদিনের টানা হরতালে যাত্রী সংখ্যা একেবারেই কম।
– এই খালি! এই খালি!!!-
জ্বি! কই যাইবেন মামা?
– নীলক্ষেত যাবো! ভাড়া নিয়ে আপনার চিন্তা করতে হবে না। আপনাকে পুষিয়ে দেবো। শুধু একটু তাড়াতাড়ি আমাকে পৌঁছে দিবেন!
-আইচ্ছা মামা।
রিকশার প্যাডেলে পা ঘুরিয়ে পথ এগোচ্ছেন গফুর মিয়া। আজ সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার ছয় বছরের মেয়েটি আবদার করেছিলো;
– বাজান, মেলা দিন হইলো ইলিশ মাছ খাইনা। আজকে কাম হইতে ফেরার পথে একটা ইলিশ মাছ নিয়ে আসতে পারবা?
– মা- রে… যদি ক্ষ্যাপ ভালো পাই। তাহলে নিয়ে আমুনে। বুঝোই তো মা তোমার বাজানের অবস্থা।
– আইচ্ছা বাজান। অহন তাইলে আর ভাত খামু না। দুপুরে ইলিশ মাছ দিয়ে গরম গরম ভাত খামু। তুমি অহন কামে যাও।
সকাল আটটায় মহাখালী এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। নয়টা বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট আগেই নীলক্ষেতে পৌঁছে গিয়েছেন কারণ আজ রাস্তায় তেমন জ্যামে পড়তে হয়নি।
– মামা এই নেন পাঁচশত টাকা। পুরোটাই রেখে দেন। এত সকালে কষ্ট করে নিয়ে আসছেন।
– আইচ্ছা মামা। আল্লায় আমনার ভালো করুক।সকাল সকাল পাঁচশত রোজগার করতে পেরে গফুর মিয়া তো বেজায় খুশি। আর ক’টা টাকা হইলেই মেয়েটার জন্য ইলিশ মাছ কিনে নিতে পারবে। তারপর কি যেন ভেবে আপনমনে খানিকক্ষণ হাসলেন…..
নীলক্ষেতের মোড় পেরিয়ে আরও একটা ক্ষ্যাপ পেলেন গফুর মিয়া। এবারের ক্ষ্যাপটা ঠিক তার বাসার কাছাকাছি। মনে মনে সে বেজায় খুশি।
-যাউক আইজ তাইলে মাইয়াডার ইচ্ছা পূরণ হইবো।
ছুটির দিন হওয়ায় আজ রাস্তায় জ্যাম কিছুটা কম, সংকীর্ণ অলিগলি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন গন্তব্যে। কলাবাগান, আসাদগেট, শ্যামলী, কল্যাণপুর অতিক্রম করে চলে এলেন গন্তব্য গাবতলিতে। যাত্রী নামিয়ে রিকশা নির্ধারিত স্থানে রেখে সরাসরি চলে গেলেন বাজারে।
বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। তবুও একান্ত প্রয়োজনীয় টুকটাক দ্রব্য ক্রয় করে গেলেন মাছ বাজারে। বাজারে ঢুকেই চোখ পড়লো বড় ইলিশ মাছটা দিকে। কিন্তু তার তো সাধ্য নেই এতবড় মাছ কিনে নিয়ে যাওয়ার। তার পাশেই ছিলো হাফ কেজি ওজনের একটা ইলিশ মাছ।
-ও ভাই, এই ইলিশ মাছটার কেজি কত করে?
– কয় কেজি নিবা তুমি?
– ভাই, একটা মাছই নেবো। ওই যে ছোটো মাছটা মাপ দেন তো!
– আচ্ছা। এ মাছটার দাম আসে চারশ আট টাকা। তুমি চারশ টাকাই দেও।
– এই নেন ভাই চারশ টাকা।
ইলিশ মাছটা ব্যাগে ঢুকিয়ে তরি গরি করে ছুটে চললেন বাসার দিকে।
-বাজান আইতাছে ইলিশ মাছ লইয়া! বাজান আইতাছে ইলিশ মাছ লইয়া! গফুর মিয়ার মেয়ের খুশির অন্ত নেই। দুপুরে রান্না হলো ইলিশ মাছের সাথে বেগুনের তরকারি। বাসার সবাই তৃপ্তি মিটিয়ে আহার করলো। মনে হয় যেন ঈদের দিন লেগেছে। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে গফুর মিয়া বের হলেন রিকশা নিয়ে। টুংটাং শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছেন জ্যাম ঠেলে। টুংটাং বেলের শব্দগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে জীবনের গল্প।