তারিক ইসলাম, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক:
‘‘আমি রাস্তার পাশে অযত্নে বেড়ে উঠা
অবহেলিত বসন্তের এক ভাঁটফুল
আমার শরীর জুড়ে ধূলোমাখা
তাই আর আমার সুবাসের কেউ
প্রশংসা করে না।
কেউ বলে না, তুমি আমার প্রিয় ফুল।’’
ফালগুন থেকে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত প্রায় সারা দেশেই ভাঁটফুলের সুবাস ও সৌন্দর্য আমাদের মাতিয়ে রাখে।এটি গ্রামবাংলার অতিপরিচিত একটি বুনোফুল।
বুনোফুল যে কত সুন্দর হতে পারে, তা ভাঁটফুলকে দেখলেই বোঝা যায়। বাংলার অপরূপ প্রকৃতির অংশ ভাঁটফুল আগে সব জায়গায় ছিল। কিন্তু এখন নগরায়ণের প্রভাবে এটি গ্রামের ঝোপঝাড়, বনবাদাড়ে টিকে আছে।
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ
বুনো ভাঁটফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছিলেন। তাঁর একাধিক কবিতায় এই ফুলের নাম এসেছে। গুচ্ছ গুচ্ছ ভাঁটফুলের হাসি কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় চিত্রিত এই ফুলের বিমুগ্ধতারই জানান দেয়।
‘এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ দেখেছিল;/বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে/কৃষ্ণা-দ্বাদশীর জোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়/সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,/শ্যামার নরম গান শুনেছিল-একদিন অমরায় গিয়ে/ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়/বাংলার নদ-নদী-ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।’
রূপসী বাংলা কাব্যে ভাঁটফুলকে অনন্য কাব্যিক মর্যাদা দিয়েছেন কবি। রুপসী বাংলা কবিতায় বাংলার নদী আর মাঠকে সঙ্গে নিয়ে যে ফুল কেঁদেছিল বেহুলার পায়, তার নাম ভাঁটফুল। সাদার মাঝে বেগুনি রঙের হালকা বিস্তারে দেখতে ভারি মিষ্টি লাগে ফুলটিকে।ফুলটির আরও কয়েকটি নাম রয়েছে। কেউ ডাকে ঘেঁটুফুল, কেউবা বলে বনজুঁই। পৌরাণিক নাম ঘণ্টাকর্ণ। নাম যাই হোক, মার্চ-এপ্রিল মাস এলেই আপন রূপে-যৌবনে উদ্ভাসিত হয়ে রুপসী বাংলার কোমল মাটির পরম আদরে সারি সারি বেড়ে ওঠে গুল্মজাতীয় এই ফুল।
ভাঁট Verbenaceae পরিবারের অন্তর্গত গুল্মজাতীয় বহুবর্ষজীবী সপুষ্পক উদ্ভিদ।
বৈজ্ঞানিক নাম: Clerodendrum viscosum
ইংরেজি নামঃ Glory Bower, Honolulu rose.আদিবাসি নামঃ ভেক পাতা (চাকমা),
ভাঁটফুল মূলত দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব একটি উদ্ভিদ। এর আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার। কিছু ঔষধি গুণও আছে এই উদ্ভিদের।
ভাঁটগাছের প্রধান কাণ্ড সোজাভাবে দণ্ডায়মান। সাধারণত দুই থেকে চার মিটার লম্বা হয়। পাতা দেখতে কিছুটা তামাকপাতার মতো এবং খসখসে। লম্বায় সাধারণত চার থেকে সাত ইঞ্চি হয়।
ডালের শীর্ষে পুষ্পদণ্ডে ফুল ফোটে। পাপড়ির রং সাদা এবং এতে বেগুনি রঙের মিশেল আছে। বসন্ত থেকে গ্রীষ্ম অবধি ফুল ফোটে। এই ফুলের রয়েছে মিষ্টি সৌরভ।গাছের উপরিভাগ পুরোটাই ফুলে ফুলে পূর্ণ থাকে। আকৃতিতে বেলিফুল থেকে কিছুটা ছোট, তবে পাপড়ি সাধারণত পাঁচটি হয়ে থাকে। প্রতিটি ফুলের পুংকেশরও প্রায় পাপড়ির মতো পাঁচটিই থাকে। অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা এ ফুলটি প্রাকৃতিক মধু জোগানে অন্যতম উৎস। ফুল ফোটার পর মৌমাছিরা ভাঁটফুলের মধু সংগ্রহ করে।
ভাঁটকে ‘ঘেঁটু’ বলা হয়ে থাকে। আদর করে একে অনেকে ‘বনজুঁই’ বলে ডাকেন। সংস্কৃতে ভাঁটকে ঘণ্টাকর্ণ বলা হয়েছে। এখনও শীত শেষে বসন্তের আগমনীতে কোথাও কোথাও ঘণ্টাকর্ণ পূজা বা ভাটি পূজা হতে দেখা যায়। এই পূজার মূল উপকরণ ভাঁটফুল। লোকবিশ্বাস মতে, বসন্তে দেবী শীতলার পূজা করা হয় বসন্ত রোগ থেকে মুক্তি পেতে। সেই বিশ্বাসে অনেকে একসময় মনে করত দেবী শীতলা প্রকৃতিতে ও মানুষের শরীরে বিস্ফোটক সৃষ্টি করেছেন। শীতলা পূজায় ভাঁটফুল অপরিহার্য। এই প্রাচীন লোকবিশ্বাসের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে জীবন রক্ষার সূত্র।ভাঁট নানা রোগের অব্যর্থ ওষুধ।
এর পাতা, ডাল ও শিকড় সবই তিতা স্বাদযুক্ত। পাতার রস কৃমি নিবারণে অত্যন্ত কার্যকর। নিয়মিত ভাঁট পাতার রস পাচকশক্তি বাড়িয়ে দিতে পারে। আজও গ্রামে বাচ্চাদের জ্বর, খোসপাঁচড়ায় ভাঁট গাছের ব্যবহার দেখা যায়। পেট ব্যথায় তথা অজীর্ণে ঘেঁটু মূলের ছাল বেঁটে রস করে খেলে পেট ব্যথার উপশম হয়। পাতার রস দুই-তিন চা-চামচ পানিতে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে কয়েক দিন খেলে ক্রিমি মলের সঙ্গে বের হয়ে যায়। তবে সতর্ক থাকতে হবে যে এই রস খাওয়ার পর ক্ষুধা বাড়ে এবং তিতা স্বাদের কারণে মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করে। তবে রস খাওয়ার পর কোনোভাবেই অন্য খাবার বা মিষ্টি খাবার খাওয়া যাবে না।
এই গাছের পাতার রস সকালে ও বিকালে সাত-আট চা-চামচ গরম পানিতে মিশিয়ে খেলে ম্যালেরিয়াও ভালো করতে পারে ভাঁট। বিছে হুল ফোটালে দারুণ যন্ত্রণা হয়। এ সময় ঘেঁটু পাতা পেস্ট করে আক্রান্ত স্থানে লাগালে দ্রুত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আজকাল বাজারে উঁকুন মারার শ্যাম্পু বা ওষুধ পাওয়া কঠিন কিছু নয়। শরীরে বা মাথায় উঁকুন থাকলে টানা দুই-তিন দিন ভাঁট পাতার রস মাথায় বা শরীরে মাখতে হবে। এরপর কিছু সময় অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেললে উঁকুন দূর হতে বাধ্য।
সতর্কতাঃ নির্দিষ্ট মাত্রা ও নিয়ম বহির্ভূত ভাবে ব্যবহার করা অনুচিত।
তথ্যসূত্র :
১.ভেষজ উদ্ভিদের কথা, প্রফেসর ড. নিশীথ কুমার পাল।
২.চিরঞ্জীব বনৌষধি খন্ড ১, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য।
৩.বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় গাছ-গাছড়া,ড. তপন কুমার দে।
৪.বনৌষধির সহজ ব্যবহার, জসিম উদ্দিন চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ আবুল হাসান।
-প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক
-তারিক ইসলাম
-সভাপতি সাতক্ষীরা বোটানিক্যাল সোসাইটি।